ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা আর যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে এবারের ভালোবাসা দিবস পালনের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কিসের কী, আমার আর ঐশীর প্রেমের বিষয়টা টের পেয়ে সব পণ্ড করে দিলেন ঐশীর বাবা বজলুর রহমান। বাংলা সিনেমার ভিলেন বাবাদের মতো তিনি গৃহবন্দী করলেন তাঁর মেয়েকে। ভালোবাসা দিবস নামের উজ্জ্বল বাল্বটি আমার চোখের সামনেই ফিউজ হয়ে গেল।
বজলুর সাহেব ঐশীর বিয়ের ব্যাপারে কোমর বেঁধে মাঠে নামলেন। এদিকে, প্রেয়সীকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা তো দূরে থাক, উল্টো ছিঁচকে চোরের মতো জানালার শিক ধরে আমার ঐশীর সঙ্গে দেখা করতে হতো। এভাবে প্রেম করতে গিয়ে একদিন জড়িয়ে পড়লাম আরেক ঝামেলায়। জানালার এপাশ-ওপাশের ব্যাপারটা নজরে পড়ে গেল স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতা মন্টুর। বলে রাখা ভালো, মন্টু ছিল ঐশীর বাবার চোখে উঁচু দরের সুপাত্র আর আমাদের প্রেমকাহিনির অন্যতম ভিলেন!
মন্টুর প্রধান কাজ ছিল, একটা বিদেশি কুকুরসহ দিনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ঐশীদের বাসার আশপাশে ঘুরঘুর করা। মন্টুকে আমি ভয় পেতাম না ঠিকই, কিন্তু তার কুকুরটাকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে শ্রদ্ধা করতাম। সেই শ্রদ্ধাকে পুঁজি করে মন্টু আঙুল উঁচিয়ে আমাকে হুমকি-ধমকি দিল। শার্টের কলার ধরে শাসিয়ে দিল, ‘আর কোনো দিন এই এলাকায় দেখলে দুটো চোখই উপড়ে ফেলে দেব।’ এত দিন শুনে এসেছি, প্রেম অন্ধ, কিন্তু কেন অন্ধ তা এই প্রথমবারের মতো টের পেলাম। এমন হুমকির পর ভালোবেসে অন্ধ হওয়ার চেয়ে ঐশীকে ভুলে যাওয়াটাই আমার কাছে শ্রেয় মনে হলো।
সবকিছু হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেত যদি না আগমন ঘটত আলাদিনের বিখ্যাত সেই দৈত্যের। এক দুপুরে বাসার ধুলোজমা জিনিসগুলো পরিষ্কার করার সময় পুরোনো একটা কুপি থেকে ধোঁয়া উড়িয়ে বিশাল আকারের দৈত্যটা বেরিয়ে এল। শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীদের মতো হাত কচলে বলল, ‘Let me introduce মালিক, আমি আলাদিন সাহেবের দৈত্য। মধ্যপ্রাচ্যের প্রচণ্ড গরমে টিকতে না পেরে এ দেশে চলে এসেছি। স্থানীয় মালিক হিসেবে এখন আপনার তিনটা ইচ্ছা পূরণ করা হবে। তবে জানিয়ে রাখছি, বিশ্বমন্দার কারণে অর্থবিত্ত-সংক্রান্ত কোনো প্রকার ইচ্ছাই পূরণ করা যাবে না।’
দেরি না করে আমি আমার প্রথম ইচ্ছার কথা দৈত্যকে জানালাম, ‘ঐশীর বাবা বজলুর রহমানকে ভয় দেখিয়ে প্যারালাইজড করে ফেলতে হবে।’ ব্যক্তি হিসেবে বজলুর রহমানকে আমার মোটেও পছন্দ না। নাম যেমন ভয়াবহ, মানুষ হিসেবেও তিনি ভয়াবহ। আলিফ লায়লার ভয়ংকর সব দৈত্য চরিত্রে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর রোল পাওয়ার কথা।
সামান্য এই ইচ্ছার কথা শুনে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী দৈত্য হাসতে হাসতে অদৃশ্য হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু মিনিট দশেক পর ফেরত এল কাঁদতে কাঁদতে! লজ্জা আর অপমানে তার মুখ লাল। দুই দৈত্যের লড়াইয়ে শেষমেশ জয় হয়েছে বজলুর রহমানের। আমি তেমন একটা আশাহত হলাম না—দৈত্যটা যে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে ফিরে এসেছে এটাই অনেক বড় পাওয়া!
আমি অশ্রুসিক্ত দৈত্যকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘ব্যাপার না বাডি। এ দেশের ক্রিকেট দল হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পরও এত লজ্জা পায় না। তার চেয়ে তুমি মন্টুকে একটা উপযুক্ত ধোলাই দিয়ে আসো, আমাকে অপমানের শাস্তি ব্যাটা পাক।’ চোখে-মুখে চাপা আতঙ্ক নিয়ে দৈত্যটা আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। এবার অপেক্ষা একটা সুসংবাদের।
আরও একবার চোখমুখ অন্ধকার করে দৈত্যটা ফেরত এল। এই মিশনটাও ব্যর্থ! মন্টুর গায়ে হাত দিলে নাকি ‘বাংলাদেশ দৈত্যলীগ’-এর কর্মীরা পিটিয়ে তার হাত-পা ভেঙে দেবে! রাজনীতিবিদদের অসীম ক্ষমতায় আমি বিস্মিত হলাম। দুটো ব্যর্থ মিশনের পর ধমকের সুরে রাগ ঝাড়লাম, ‘তাহলে তুমি পারোটা কী?’ দৈত্যটা হেসে বলল, ‘মালিক, আপনার ইন্টারনেটের স্পিড ডাবল করে দিই?’ আমি গলায় সর্বশক্তি এনে ধমক দিলাম, ‘দূর হও চোখের সামনে থেকে।’ মন খারাপ করে দৈত্যটা বোতলের ভেতর ফিরে গেল।
সে রাতেই মাথায় একটা বুদ্ধি এল। কুপি ঘষে দৈত্যকে বের করলাম আরেকবার। জানতে চাইলাম, কুকুরের শরীরে ভর করার ক্ষমতা তার আছে কি না। ইতিবাচক উত্তর পেয়ে অবশেষে সর্বশেষ ইচ্ছাটার কথা জানালাম তাকে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল ঐশীর টেলিফোনে। তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেছে! উত্তেজনায় সে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। মন্টুর বিদেশি কুকুরটা কোনো কারণ ছাড়াই রাস্তায় বজলুর রহমানকে কামড়ে দিয়েছে। কুকুরের কাজ কুকুর করলেও বদরাগী বজলুর রহমান লাঠির এক বাড়িতেই মেরে ফেলেছেন কুকুরটাকে! আর ঘটনার আকস্মিকতায় ঘটনাস্থলেই ছোটখাটো স্ট্রোক করেছে মন্টু।
আমি ফুল নিয়ে মন্টু ও বজলুর রহমান দুজনকেই হাসপাতালে দেখতে গেলাম, আর অপেক্ষায় রইলাম একটা উষ্ণ ভালোবাসা দিবসের...।